কঙ্কসেন রায়, সৈয়দ বুখারী ও কাঁকসা-সেনভূমের ইতিহাস ও কঙ্কেশ্বর মহাদেব © জ্যোতিষ্মান সরকার

মন্দিরের পিছনে বর্তমানে জীবৎ কুন্ড। যার অধিকাংশ‌ই বেদখল হয়ে গেছে।কিছুদিন আগেই গেছিলাম।

প্রণাম মন্ত্র:-কঙ্কেশ্বরং মহাদেবম্ অনাদি লিঙ্গ রূপিনং।সভৈরবং কাঁকসা সদ্‌দগোপ রাজ কুলদেবম্ ।। কাঁকসা গ্রামেহধিষ্ঠিতাং ভবসাগর তারকংভক্ত বাঞ্ছা কল্পতরুং প্রণমামি বারংবারম্।।

১২০৩ খ্রি:

সেন ভূমির মহারাজা কঙ্কসেন রায়। গৌড়ের ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা ।

হলায়ুধ মিশ্র লিখলেন চতুর্বিশোত্তরে শাকে সহস্রৈক শতাব্দীকেবেহার পাটনাত্ পূর্বং তুরস্ক সমুপাগত।।

নালন্দা লুণ্ঠিত ও ধ্বংস হলো নালান্দা।স্বভাবতঃই মিথিলা ও গৌড় ও বরেন্দ্র অঞ্চলে সেন বংশীয় রাজারা। দুর্গ গুলিতে সৈন্যসজ্জা শুরু করলেন।

যুদ্ধ আসন্ন।

কিন্তু বক্তিয়ারের চিন্তায় অন্য কিছু ছিল। আক্রমণ হলো রাজমহলের পাহাড়ি এলাকার ওপর দিয়ে।

50000 প্রশিক্ষিত অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে রাজমহল অতিক্রম করে বক্তিয়ার বাহিনী প্রবেশ করলো অজয় দামোদর উপত্যকায়।কাঁকশার মধ্যবর্তী জঙ্গলে স্থাপন করল সৈন্য শিবির।

সেনভূমের সদগোপ রাজা কঙ্কসেন রায় কঙ্কেশ্বর শিবের উপাসক, রাজধানী কাঁকশা।

রাজ্যের সীমান্তে যবন সৈন্যের আগমনের সংবাদ পৌঁছল রাজার কাছে। এই মুহূর্তে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কঙ্কসেন।

রাজপুত্র কণকসেন সৈন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরে সৈন্য সংগ্রহ করলেন। মাতৃভূমি রক্ষা করবার জন্য বর্গ ক্ষত্রিয়,উগ্র ক্ষত্রিয়,গোপ,হাঁড়ী,ডোম সৈন্যরা একত্রিত হলো।

পর্বতের উপরের অংশে থাকার কারণে যবণ সৈন্যদের কৌশলগত সুবিধা ছিল। কিন্তু তাতে সেন ভূম সৈন্য দমে গেল ‌না ।

জয় কঙ্কেশ্বর মহাদেবের জয় আকাশ শব্দে মুখরিত হলো। সেন ভূমের পক্ষে কনক সেন রায় ও তুর্কিদের পক্ষে সৈয়দ বুখারী সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করছিলেন । শেষ পর্যন্ত যবন সৈন্যকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেন কণক সেন রায়।

যুদ্ধে সৈয়দ বোখারী মারা যায়। কিন্তু বক্তিয়ার অন্যত্র সৈন্যের একটি অংশকে লুকিয়ে রেখেছিল। সেই অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে গড় আক্রমণ করে বক্তিয়ার। এই সময় রাজধানীতে সৈন্যসংখ্যা অল্প ছিল। পরিখার সন্মুখে দুর্গ রক্ষা করতে নিজে অস্ত্র তুলে নেন বৃদ্ধ রাজা কঙ্কসেন রায়।

এভাবে দুর্গ রক্ষা করতে করতেই মারা যান কঙ্ক সেন রায়।কঙ্কাস নগর লুন্ঠিত হয় মন্দির ধ্বংস হয়।

দুর্গ দখলের এই সংবাদ যখন অগ্রবর্তী বাহিনী পায়। রাজার মৃত্যুতে অধিকাংশের মনোবল ভেঙে পড়ে এবং বাহিনী ভেঙে যায় কণক সেন রায় আত্মগোপন করে ভালকি রাজ্যে আশ্রয় নেন।

পরবর্তীতে বক্তিয়ার নদীয়ার দিকে অগ্রসর হয়। কনক সেন রায় জঙ্গলের মধ্যে পরবর্তীকালে উদগড়ে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।

সৈয়দ বুখারীর সমাধি কাঁকশার পাশে প্রয়াগপুরে অবস্থিত। সদগোপ কুলীন সংহিতা অনুসারে পানাগর স্টেশন থেকে উত্তরমুখী যে রাস্তা যাচ্ছে সেটা ধরে গিয়ে পশ্চিম দিকে কাঁকশা গ্রামের প্রান্তে কঙ্কেশ্বর মহাদেবের মন্দির অবস্থিত। দেবমন্দিরের পিছনে একটি পুষ্করিণী রয়েছে যেটাকে জিয়ৎ কুন্ড বলা হয়। দুর্গের চারদিকে পরীখা ছিল একথাও উল্লেখ করেছেন লেখক।সদগোপ সমাজের রাঢ়ীয় পশ্চিমকূল সমাজের এটি খুব প্রসিদ্ধ মন্দির‌ এবং কাঁকশা বংশের কূল দেবতা।

এমন একটি মন্দির 100 বছরের মধ্যে অবলুপ্ত হয়ে যাবে সেটা সম্ভবপর নয়।বর্তমানে গুগল ম্যাপে খুঁজতে গিয়ে কঙ্কেশ্বর মন্দির না পেলেও কঙ্কেশ্বরী দুর্গা মন্দির নামে একটি মন্দির খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কাঁকশা মেইন রোডের পাশে তুলনামূলক নতুন। কিন্তু গ্রন্থে উল্লেখিত বিবরণের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। পার্শ্বে একটি রাঢ়ীয় রীতির চালা স্থাপত্যের পুরনো শিব মন্দির বর্তমান। খুব সম্ভবত এটাই সেই বিখ্যাত কঙ্কেশ্বর শিব মন্দির। বর্তমানে সেই শিব মন্দির কে আশ্রয় করে দুর্গা দালানটি গড়ে উঠেছে।

মন্দিরটির পিছনে একটি ছোট পুকুর বর্তমান। সম্ভবত এটাই সেই জিয়ৎ কুন্ড ।চারদিকে অনেকগুলি বড় বড় পুকুর দেখা যায় পূর্ববর্তী তাহলে এগুলো একটি মিলিত পরিখা ছিল সহজেই অনুমান করা যায়।

পরবর্তী ইতিহাস সম্পর্কে অল্প কিছু বলে রাখা প্রয়োজন। ১৩৫৫ নাগাদ গৌরীহর মিত্রের বীরভূমের ইতিহাস অনুসারে বঙ্গদেশে এক বিরাট রাষ্ট্রবিপ্লব উপস্থিত হয়।

সম্ভবত সেই সময়েই ভাল্কিতে মহিন্দ্র সিংহের উত্থান হয়।

বিভিন্ন প্রান্তে বহু হিন্দু নৃপতি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সম্ভবত মহেন্দ্র সিংহ তাঁদের মধ্যেই ছিলেন একজন। নিজ কন্যার সাথে মহেন্দ্র সিংহ কঙ্কসেনের বংশীয় (সম্ভবত পৌত্র) প্রতাপাদিত্য রায়কে বিবাহ দেন। এবং পুনরায় হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করে সিংহাসনে বসান।

মহেন্দ্র সিংহ প্রতাপশালী নৃপতি ছিলেন। দিল্লি সালতানাতের পাঠানো ফৌজদার সৈয়দ বর্মন কে জামতাড়ার( সম্ভবত ঝাড়খন্ডে) যুদ্ধে পরাজিত করেন।

একই সময় কালে প্রতাপাদিত্যোও বহু বহিরাগত আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। এক গাজীকে তিনি যুদ্ধে পরাজিত করে কারারুদ্ধ করেন।

যে কারণে দিল্লির সুলতান তাঁর বিরুদ্ধে বারংবার অভিযান প্রেরণ করেও ব্যর্থ হয়। প্রতাপাদিত্য ও মহেন্দ্র সিংহের সময় কালে উত্তর রাঢ় পুনরায় হিন্দু শাসনে এসেছিল।

পরবর্তী ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। এই মন্দিরে কঙ্কেশ্বর মহাদেবের গাথাবলী নামে একটি পুরনো পুঁথি ছিল যেটি ১২৭১ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসের ( 1869 AD) ঝড়ে নষ্ট হয়ে যায়।

মন্দিরের পূজারীর বিবরণ অনুসারে পিছনের ১৩০৭ সালের ১০ ই পৌষ পুকুরটির মালিক আব্দুল সত্তার পুকুরটি খননকালে কিছু দেব মুর্তি উদ্ধার হয়। যেটি আবিষ্কার হওয়ার পরেই খননকার্য বন্ধ করে দেয়া হয়। এই অঞ্চলে একটি সুপ্রাচীন নগরী ছিল এটি সেটাই প্রমাণ করে।

তথ্যসূত্র :

সদগোপ কুলীন সংহিতা-মোক্ষদা প্রসাদ রায় চৌধুরীসদগোপ তত্ত্ব- শরৎ চন্দ্র ঘোষগোপভূমের স্বরূপ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি -শিব শঙ্কর ঘোষ

#kanksha #gopbhum #sadgope_architecture #sadgoperoyalarchives #কাঁকশা